চাকরি নাকি মুক্তপেশা
ফ্রিলান্সিং বা মুক্তপেশা নিয়, অনেকেরই এক ধরনের বিভ্রান্তি বা ভুল ধারনা আছে। ফ্রিল্যন্সিং মানে হচ্ছে মুক্ত পেশা বা স্বাধীন পেশা। সে হিসেবে কৃষক, ব্যাবসায়ী, আইনজীবী, এমনকি রাস্তার মোড়ের ফুচকাওয়ালাও ফ্রিল্যন্সার। কারন তারা স্বাবলম্বী, কারো অধীনে চাকরি করে না। কিন্তু আমাদের দেশে ফ্রিলান্সার বলতে, সাধারণত আমরা যারা অনলাইন ফ্রিলান্সিং এর সাথে জড়িত তাদেরকেই বুঝি। আসলে অনেক সময় ভুল অনেক কিছু, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। কিছু করার নেই। যেমন “এই খালি” বলে কাউকে ডাক দিলে বুঝা যায়, রিকশাওয়ালা, আবার “এই সিএনজি” বললে বুঝতে হবে, কেউ সিএনজি চালিত অটোকে ডাকছে। যদিও সবই ভুল।
যা হোক বলছিলাম চাকরী করব নাকি আমি উদ্যোক্তা হব এই বিষয়ে। কিছু দিন আগে প্রথম আলোতে একটা জরিপ প্রকাশিত হয়েছিল যে, আমাদের দেশের ৮৫% তরুনের নিদিষ্ট কোন লক্ষ্য নেই। পড়াশোনা শেষ করে কে কি করবে, তারা তা জানে না। চাকরি করবে না স্বাধীন পেশায় যাবে সেটাও ঠিক করতে পারে না। আসলেই এটাই বাস্তবতা। আমাদের বেশিরভাগ তরুণ তরুণীদের পড়াশোনা শেষে কোন লক্ষ্য থাকে না, মোটামুটি একটা চাকরী পেলে, আর কিছু লাগে না। বিশেষ করে সরকারী চাকরী পেলে, সে যেন আকাশের চাঁদ পেয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবতা কি আমরা ভেবে দেখেছি। সাম্প্রতিক বিসিএস পরীক্ষায়, যে পরিমান দরখাস্ত জমা পড়েছে তার সংখ্যা নাকি মালদ্বীপের জনসংখ্যার থেকেও বেশি। মানে চার লক্ষেরও বেশি। অথচ নেয়া হবে মাত্র হাজার দেড় বা দুই হাজারের মত প্রার্থীকে। এর পরে আছে বিভিন্ন ধরনের কোটা। আর কোটা বিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে আমরা সবাই কম বেশি জানি।
আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস
আমার মতে স্বাধীন প্রতিটি পেশা সেটা শিল্প, ব্যবসা, কৃষি, ইত্যাদি যেমন কিছু হোক না কেন, সবকিছুতেই ভালো করা সম্ভব। মুন্নু সিরামিকস বিশ্বে সিরামিকসের ক্ষেত্রে তিন নম্বর প্রতিষ্ঠান। আমাদের গার্মেন্টস শিল্প এখন বৈদেশিক আয়ের মূল উৎস। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ার পরও আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
স্বাধীনতার পরে আমাদের খাদ্যে চরম ঘাটতি ছিল। এখন আমরা খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ, শুধু তাই নয় স্বাধীনতার পরে, আমাদের খাদ্য উৎপাদন প্রায় চার গুন বেড়েছে। এর মুল অবদান এই স্বাধীন পেশাজীবীদের। আজ থেকে ৪০০ বছর আগে আমাদের পূর্ব পুরুষরা প্রধানত তিনটি পেশায় নিয়োজিত ছিলেন ব্যবসা, শিল্প এবং কৃষি। তখন চাকরি করার প্রবণতা তেমন ছিল না। কৃষিতে তাদের মেধা এত বিকশিত হয়েছিলো যে, ৩৫০ প্রজাতির ধান উৎপাদন করতেন তারা। যত ধরনের সুগন্ধি মশলা আছে সবই তারা উৎপাদন করতেন।
শিল্পে তারা মেধাকে এত বিকশিত করেছিলেন যে, মসলিনের মতো সূক্ষ্ম কাপড় তৈরি করতেন। টেক্সটাইল টেকনোলজির সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন এই মসলিন। আজ পর্যন্ত তুলা থেকে এর চেয়ে মিহি কাপড় তৈরি করা সম্ভব হয় নি। বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত মসলিনের মত কাপড় তৈরি করতে পারেনি। ঢাকা যাদুঘরে গেলে মসলিন দেখতে পারবেন। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ আঁশের তুলা উৎপাদিত হতো যশোর এবং বরেন্দ্র এলাকার আশপাশে। আমাদের সওদাগরেরা সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিতেন। চট্টগ্রামে জাহাজ তৈরি হতো। চট্টগ্রামে যে ‘বহদ্দার হাট’ রয়েছে সেটি ছিলো ‘বহরদার’ অর্থাৎ নৌবহরের দার বা প্রধানের জায়গা। আমাদের কারিগররা জাহাজ বানাতেন। সেই জাহাজে তারা জাভা, সুমাত্রা, মালদ্বীপ, সিংহল প্রভৃতি দেশে যেতেন। বালিতে রামায়ণের নাটক অভিনয় তাদের সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়েছে। কারণ তাদের পূর্বরুষেরা এই বাংলা থেকেই গিয়েছিলেন।
বাংলার বীর বিজয় সিংহ সিংহলের পত্তন করেন, সিংহল নাম তার নামানুসারেই বর্তমানে যাকে আমরা শ্রীলংকা হিসেবে চিনি। মধ্যযুগে ভাইকিংরা যে জাহাজ দিয়ে যুদ্ধ করত, তা এই বাংলা থেকেই গিয়েছিলো। ভাইকিংরা আমাদের তৈরি জাহাজ দিয়ে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় পৌঁছেছিল। সেটা কলম্বাসের অনেক আগের কথা। সমুদ্রযাত্রা আমাদের সংস্কৃতির এত অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিলো যে, চাঁদ সওদাগরের কাহিনীর মতো লোকসাহিত্য সৃষ্টি হয়েছিলো। ফলশ্রুতিতে সেসময় আমাদের এই উপমহাদেশের জিডিপি ছিলো বিশ্বের জিডিপির ২২-২৩%। আর তখন ইংল্যান্ডের জিডিপি ছিলো বিশ্ব জিডিপির এক শতাংশ মাত্র। মুর্শিদাবাদ ছিলো লন্ডনের চেয়েও বড় শহর।
আমাদের পেশা সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি বদল হল যেভাবে
ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসনামল থেকে আমাদের পেশা সংক্রান্ত ধ্যানধারণা, পরিবর্তিত হতে শুরু করল। ইংরেজরা আমাদের ব্রেইন ওয়াশ করে, আমাদের মানুসিকতাই চেঞ্জ করে দিল। আমাদের মধ্যে ধারণা সৃষ্টি হলো যে, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সৃজনশীল কাজগুলো করার কোনো ক্ষমতাই আমাদের নেই। আমাদের অবস্থা দাঁড়ালো, খাঁচায় আবদ্ধ পাখির মতো। এন্টারপ্রেনিউয়ার বা উদ্যোক্তা হবার স্পিরিট হারিয়ে, আমরা নিজেদেরকে শুধুমাত্র চাকরিজীবী অর্থাৎ চাকর ভাবতেই স্বাছন্দ্যবোধ করতে শুরু করলাম। সেই ঔপনিবেশিক ধ্যান ধারণা আমরা এখনো ধারন করি। এখনো চাকরগিরি বা চাকরি করা আমাদের প্রথম পছন্দ। যেখানে আমাদের পূর্বপুরুষ সওদাগরেরা সাত সমুদ্র তেরো নদী অনায়াসে পাড়ি দিতো, সেখানে সৃষ্টি হলো কালাপানির ধারণা, অর্থাৎ কেউ সমুদ্র যাত্রা যদি করে, তো তার জাত চলে যাবে, জাতচ্যুত হবে। ফলে কালক্রমে আমরা পরিচিত হলাম দুর্ভিক্ষপীড়িত, বন্যা কবলিত, জরা-ব্যাধি জর্জরিত একটি জনপদ হিসেবে। দেশ ভাগের পরেও আমাদের কোন উন্নতি হয়নি, তাইত পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হবার পর, কিসিঞ্জার আমাদেরকে তলা বিহীন ঝুড়ি হিসেবে বলতে সাহস পেয়েছিল।
আশার কথা
আশার কথা হচ্ছে আমাদের বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে স্বাধীন পেশার প্রতি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। অনেকেই এখন স্বাধীন পেশায় ভাল করছে। দেশে এখন অনেক সুযোগ তৈরি হয়েছে। অনলাইনে কাজ করতেই হবে এমন নয়। এর বাহিরে শিল্প, ব্যবসা, কৃষি ইত্যাদি ক্ষেত্রে কাজের অনেক সুযোগ তৈরি হয়েছে। কাজেই যারা ফ্রিল্যন্সিং এর নামে অনলাইনে পড়ে থেকে কিছুই করতে পারছেন না, তারা অন্য দিকেও চেষ্টা করতে পারেন। লেগে থাকলে সাফল্য আসবেই।
একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা
আমাদের মধ্যে ভুল একটা ধারনা আছে বা আমারা মনে করি সরাসরি একটা ব্যাবসা বা স্বাধীন পেশায় নেমে গেলেই হবে। এর থেকে ভুল ধারনা আসলে কোন কিছু হতে পারে না। আমি কিন্তু চাকরি করার বিরোধী নই। আমি বলব স্বাধীন পেশা বেছে নেয়ার আগে কিছু দিন চাকরি করা। কারন হচ্ছে কোন ব্যাবসা বা স্বাধীন পেশা শুরু করতে হলে, সেটার সম্পর্কে আপনার খুব ভাল ধারনা থাকতে হবে। না হলে বার্থ হবার সম্ভবনা শতভাগ। আর এই ধারনা পাবার জন্য উচিৎ কিছুদিন চাকরি করা, বা হাতে কলমে শিক্ষা নেয়া। মুন্নু সিরামিকসের কথা বলছিলাম, তার প্রতিষ্ঠাতা হারুন উর রশিদ খান মুন্নু, খুব সুন্দর একটা কথা বলেছিলেন। আর সেটা হচ্ছে কোন ব্যাবসা শুরু করতে গেলে, আগে উচিৎ সেই সেক্টরে চাকরি করে ভাল অভিজ্ঞতা অর্জন করা, এর পরে ব্যাবসা শুরু করা। এটা না করলে সে ফেল করবে। আমারও একই মত। প্রত্যেক ব্যবসা বা স্বাধীন পেশার সাফল্যের একটা গুপ্ত রহস্য আছে। সেটা এমনি এমনি বোঝা যায় না। সেটা বুঝতে হলে অনেক গভিরে ডুব দিতে হবে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে।
একটি শিক্ষণীয় গল্প
একটা গল্প মনে পড়ে গেল। অনেক আগে এক ব্যবসায়ীর গল্প। তিনি বাংলাদেশ থেকে অর্ধ প্রক্রিয়াকৃত চামড়া বিদেশে পাঠা্তেন। সেই চামড়া বিদেশে পাকা করে, বিদেশি বায়ার আবার দেশে পাঠাত। সেই পাকা চামড়া দিয়ে জুতা তৈরি করে, আবার বিদেশে রপ্তানি করা হত। তিনি অনেক চেষ্টা করেছেন, সেই চামড়া পাকা করার রহস্য বের করতে, যেন দেশেই সব কিছু করা যায়। কিন্তু বিদেশি বায়ার কোন মতেই গোমর ফাঁস করে না। পরে তিনি খোঁজ নিয়ে জানলেন যে, এই অর্ধ পাকা চামড়া নাকি হংকং এর প্রক্রিয়াজাত করে পাকা করা হয়। তিনি হংকং এ যান, অনেক চেষ্টা করেন ফ্যাক্টরি ভিজিট করার। কিন্তু কোন সুযোগই পাচ্ছিলেন না, এতটাই গোপনে সব কিছু হয় যে, বাহিরের কাউকে ঢুকতেই দেয় না। পরে তিনি বুদ্ধি করে, একজন সাধারণ অভিবাসি শ্রমিক হিসেবে সেই কারখানায় চাকরি নেন। প্রায় তিন মাস সেই কারখানায় পড়ে থেকে, সব কিছু হাতে কলমে ভাল করে শেখেন। সব শেখা শেষ হলে, তিনি দেশে ফেরত আসেন। তিনি তার কারখানা নিয়ম অনুযায়ী আপগ্রেড করেন। আগে যে অর্ধ প্রক্রিয়াজাত চামড়া পাকা করার জন্য, বিদেশে পাঠানো হত, সেটা আর করার দরকার লাগল না। তার ব্যাবসা খুব দ্রুতঁই ফুলে ফেপে উঠল। আসলে এটা থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। আপনার যদি পোল্ট্রি ফার্ম দেয়ার ইচ্ছা থাকে, আমি বলব আগে ৬ মাস একটা পল্ট্রি ফার্মে চাকরি করেন। দরকার হলে তাদের অগ্রিম টাকা দেন, কাজ শেখার জন্য। যদি ফ্রিলান্সিং করতে চান তবে সফল কোন ফ্রিলান্সারের আণ্ডারে বেশ কিছুদিন ইন্টার্নশিপ করে। আপনি অবশ্যই সফল হবে। এটা আসলে অন্য যে কোন ব্যাবসা বা স্বাধীন পেশার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
পরিশিষ্ট
স্বাধীন পেশায় বা ফ্রিলান্সিং করতে যাওয়া নিয়ে আপনার যে হতাশা, যে বিভ্রান্তি ক্যারিয়ার সংক্রান্ত এ হতাশা ও স্তবিরতার মূলে রয়েছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিগত অবক্ষয়। ১০/১২ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি নিয়ে আমরা এখনো গর্ব করি। অথচ স্বাধীন পেশায় কত অনাগ্রহ। আসলে যত আমরা পূর্বপুরষদের সেই সাহসী চেতনাকে, সেই উদ্যোগ ও উদ্যমকে জাগ্রত করতে পারবো, তত আমাদের মেধাকে আবারো শতধারায় বিকশিত করতে পারবো। নিজের অনন্য মেধাকে কাজে লাগিয়ে আমরা স্বাধীন পেশায় সফল হতে পারব। আসলে স্বাধীন পেশায় যে মজা সেটা চাকরীতে নেই।
যারা স্বাধীনপেশায় আছে তাদের সালাম জানাই। আর যারা স্বাধীনভাবে কিছু করতে চান তাদের স্বাগত জানাই। অযথা সময় নষ্ট না করে নেমে পড়ুন। পথে নামলে পথই পথ দেখায়!
ধন্যবাদ!
No comments:
Post a Comment